গাজায় ২১ মাসেরও বেশি সময় ধরে ইসরায়েলের আগ্রাসন অব্যাহত রয়েছে। এ সময়ে দখলদার বাহিনী অঞ্চলটিতে ১ লাখ ২৫ হাজার টন বিস্ফোরক ফেলেছে, যার ফলে ফিলিস্তিনি অঞ্চলটির ৮৮ শতাংশই পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেছে। 

আর এতে গাজার আর্থিক ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ৬২ বিলিয়ন ডলারের বেশি। তুরস্কের রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থা আনাদোলু এজেন্সির এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়।

এতে বলা হয়েছে, ইসরায়েলের গাজা উপত্যকায় ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে গণহত্যামূলক যুদ্ধ শুরু করার পর অঞ্চলটির মোট এলাকার ৮৮ শতাংশের বেশি ধ্বংস করে দিয়েছে এবং ২০ লাখের বেশি ফিলিস্তিনিকে বাস্তুচ্যুত করেছে। শুক্রবার (১৮ জুলাই) গাজা সরকারি জনসংযোগ বিভাগ প্রকাশিত এক পরিসংখ্যান প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা গেছে।

গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসনের ৬৫০ তম দিন উপলক্ষে প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইসরায়েল গাজায় ১ লাখ ২৫ হাজার টন বোমা ফেলেছে এবং এর ফলে ক্ষতির পরিমাণ ৬২ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। এই নির্মম যুদ্ধের ফলে ‘২০ লাখের বেশি সাধারণ মানুষকে জোরপূর্বক সরিয়ে নেওয়া হয়েছে’ এবং উপত্যকার ৩৬০ বর্গকিলোমিটারের ৭৭ শতাংশ ভূখণ্ড দখল করে নিয়েছে ইসরায়েল।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, এ পর্যন্ত মোট ৬৭ হাজার ৮৮০ জন ফিলিস্তিনি নিহত ও নিখোঁজ হয়েছেন। তাদের মধ্যে ১৯ হাজারের বেশি শিশু ও ১২ হাজার ৫০০ নারী। নিহত নারীদের মধ্যে ৮ হাজার ১৫০ জন মা এবং ৯৫৩ জন শিশু।

গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, তারা কেবল হাসপাতালে পৌঁছানো মৃতদেহ হিসাব করে, সে অনুযায়ী নিহতের সংখ্যা এখন ৫৮ হাজার ৬৬৭ জন। এদিকে জনসংযোগ বিভাগ বলছে, তাদের হিসেবে ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকে পড়া ও নিখোঁজদেরও ধরা হয়েছে, সে কারণেই সংখ্যাগত পার্থক্য দেখা যাচ্ছে।

জনসংযোগ বিভাগ আরও জানিয়েছে, এখনো প্রায় ৯ হাজার ৫০০ জন ফিলিস্তিনি ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে আছেন। এ ছাড়া ইসরায়েলি বাহিনী ১ হাজার ৫৯০ জন চিকিৎসাকর্মী, ২২৮ জন সাংবাদিক এবং ৭৭৭ জন মানবিক সহায়তা কর্মীকে হত্যা করেছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

গাজার স্বাস্থ্যখাতের ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরে বলা হয়, যুদ্ধের কারণে স্বাস্থ্য পরিকাঠামো ভেঙে পড়ায় ও জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুতির ফলে ২১ লাখেরও বেশি মানুষ সংক্রামক রোগে আক্রান্ত হয়েছেন। এর মধ্যে ৭১ হাজারের বেশি মানুষ হেপাটাইটিসে আক্রান্ত।

এ ছাড়া, গাজায় ২ হাজার ৬১৩টি ফিলিস্তিনি পরিবার পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। অর্থাৎ, এসব পরিবারের আর কোনো সদস্য জীবিত নেই। অন্তত ৬৮ জন শিশু অপুষ্টিতে এবং আরও ১৭ জন শীতে মারা গেছে বিভিন্ন আশ্রয়শিবিরে। এখন পর্যন্ত ১ লাখ ৩৯ হাজার মানুষ আহত হয়েছে। তাদের মধ্যে ৪ হাজার ৭০০ জনের শরীরের কোনো না কোনো অঙ্গ কেটে ফেলতে হয়েছে।

জনসংযোগ বিভাগের অভিযোগ, ইসরায়েলি বাহিনী এখন পর্যন্ত ২ হাজার ৪২০টি মৃতদেহ কবর থেকে তুলে নিয়ে গেছে এবং হাসপাতালের ভেতরে সাতটি গণকবর তৈরি করেছে। এ ছাড়া, গাজা থেকে ৬ হাজার ৬৩৩ জন সাধারণ মানুষকে আটক করা হয়েছে, যাদের মধ্যে ৩৬২ জন চিকিৎসাকর্মী, ৪৮ জন সাংবাদিক ও ২৬ জন সিভিল ডিফেন্স সদস্য।

ইসরায়েলি বাহিনী গাজার ৩৮টি হাসপাতাল ও ৯৬টি প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র ধ্বংস করেছে। তারা ১৪৪টি অ্যাম্বুলেন্স লক্ষ্য করে হামলা চালিয়েছে এবং ১৫৬টি স্কুল পুরোপুরি এবং আরও ৩৮২টি আংশিকভাবে ধ্বংস করেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, গাজায় ৮৩৩টি মসজিদ, তিনটি গির্জা এবং ৪০টি কবরস্থানও ইসরায়েলি বাহিনীর হামলার লক্ষ্য হয়েছে।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, মোট ২ লাখ ৮৮ হাজার পরিবার গৃহহীন হয়েছে। ইসরায়েলি হামলায় ২ লাখ ২৩ হাজার বসতবাড়ি ধ্বংস হয়েছে এবং আরও ১ লাখ ৩০ হাজার বসতবাড়ি বসবাসের অযোগ্য হয়ে গেছে। ২৬১টি আশ্রয়কেন্দ্রেও হামলা চালানো হয়েছে।

এ ছাড়া ইসরায়েল গত ১৩৯ দিনের বেশি সময় ধরে হাজার হাজার ত্রাণবাহী ট্রাকের প্রবেশ ঠেকিয়ে রেখেছে। গাজার কৃষি খাতও মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ৯২ শতাংশ আবাদযোগ্য জমি ধ্বংস করে ফেলার কারণে এ খাতের ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার। একই সঙ্গে পানি, বিদ্যুৎ, পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থা এবং প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনাও ব্যাপকভাবে ধ্বংস হয়েছে।

গত নভেম্বরে যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ও সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্তের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছে। একইসঙ্গে ইসরায়েল গাজায় গণহত্যার অভিযোগে আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার আদালতে বিচারাধীন রয়েছে।